গ্রামের মেঠো পথ ধরে একদল ছেলে-মেয়ে আনন্দে হৈচৈ করতে করতে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষের পিছনে হাঁটছে, এই দৃশ্যটি হয়তো হ্যামলিনের বংশীবাদকের গল্পের কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। তবে এ গল্পের ব্যক্তি ঐ শিশুদেরকে চিরকালের জন্য কোন অন্ধকার গুহায় বন্দী করার জন্য নিয়ে যান নি। এ গল্প একজন আলোর পথ প্রদর্শক একজন নিবেদিত প্রান শিক্ষকের গল্প। গ্রামের ছেলেমেয়েরা একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের লাভের লক্ষ্যে প্রতিদিন হেঁটে চলতো এই শিক্ষক আশরাফুল বিশ্বাস এর পিছনে। ২৯ মে ২০২০-এ যার মৃত্যু গোটা বাহা’ই সমাজকে শোকাহত করে দেয়।
১৯৮২ সালের দিকের কথা। বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামের মতই আধুনিক সুযোগ সুবিধা, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বঞ্চিত এমনই একটি প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। ভানপুর। রাতের অন্ধকার দুর করতে কেরসিন চালিত কুপি বা হারিকেন ছিল তাদের রাতের আলোর একমাত্র সম্বল। এই গ্রামের সৈয়দপুর শহিদ মঞ্জু উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আশরাফুল বিশ্বাস, যিনি ‘নানা’ নামেই ছোট-বড় সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন। তখনকার দিনে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের এই এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ ছিলো। আর্থিক সামর্থ্য এবং শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া সত্বেও গোদাগাড়ী উপজেলার ভানপুর গ্রামের অনেকেই এই কারণে তাদের সন্তানদেরকে স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী ছিলেন না।
আশরাফুল বিশ্বাস পায়ে হেটে গ্রামে বাড়ি বাড়ি অভিভাবকদের কাছে যেয়ে তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানেরার অনুপ্রেরণা দিতেন। যে সমস্ত অভিভাবকদের স্কুলের বেতন দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না, গোপনে তিনি তাদের স্কুল খরচও বহন করতেন। তার এই অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ভানপুর গ্রাম থেকে ২০ থেকে ২৫ জন সৈয়দপুর হাই স্কুলে ভর্তি হল। শিশুদের প্রতি আশরাফুল বিশ্বাসের সেবা এখানেই থেমে থাকেনি। প্রতিদিন বিকেলে তিনি ঘরে ঘরে গিয়ে স্কুলের ছেলে-মেয়েদের নিজ বাসায় নিয়ে আসতেন। ভাল ফল লাভের লক্ষ্যে ছাত্রদের বিনা টাকায় প্রাইভেট পড়াতেন। তিনি অত্যন্ত যত্ন করে তাদেরকে পড়াতেন এবং তাদের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করতেন। যে সকল ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠ্যপুস্তক কেনার সামর্থ্য থাকতো না, তিনি তাদের বই কেনার ব্যবস্থাও করে দিতেন। এই সবকিছুর বিনিময়ে অভিভাবকদের থেকে কোনদিন তিনি কোন টাকা পয়সা গ্রহণ করেন নাই।
সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার এই সচেতনতা তাকে বামপন্থি রাজনীতির দিকে উদ্বুদ্ধ করে, তিনি নিজেকে সম্পুর্ণরূপে বামরাজনীতির জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। বামরাজনীতির সাথেযুক্ত অন্যন্ত ঘনিষ্ট একজন সহযোগী একদিন নানাকে বলেন- ‘আমরা মানবমুক্তির যে পথ অনুসন্ধান করছি, আমি তা পেয়েছি।’ সে আশরাফুল বিশ্বাসকে বাহা’ই ধর্ম সম্পর্কে জানান। আশরাফুল বিশ্বাস এই নতুন বাণীর সত্যতা সম্পর্কে গভীরভাবে অনুসন্ধান শুরু করেন। বাহাই বিশ্বাস যে মানবমুক্তির প্রকৃত পথ, একথা বুঝতে তার বেশী দিন লাগে নাই। পরিশেষে ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ তিনি নিজেকে একজন বাহা’ই হিসেবে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন।
তিনি বাহা’ই ধর্ম গ্রহণ করার পর অত্যন্ত উৎসাহের সাথে এই ধর্মের মুলবানীসমূহ নিজ গ্রামবাসীদেরকে জানাতে শুরু করলেন। তার এই শিক্ষাদানের মাধ্যমে গ্রামের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি বাহা’ই ধর্ম গ্রহণ করেন। ফলশ্রুতিতে গ্রামে বাহা’ইদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সাধারণগ্রামবাসী ভীত হয়ে পড়ে, গ্রামের ধূর্ত মাতবরদের সাথে গোপন পরামর্শ শেষে কুচক্রী গ্রামবাসী রটনা শুরু করে অর্থের বিরুদ্ধে সকলেই বাহাই ধর্ম গ্রহণ করছে। প্রকৃত সত্যের বানী আলোতে আলোকিত হয়ে দলে দলে গ্রামের সরলপ্রাণ মানুষ বাহাই ধর্মে র পতাকাতলে সমবেত হতে শুরু করে। এই সময় ভানপুর গ্রামের কয়েকজন সম্মানিত, অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল এবং শিক্ষিত ব্যক্তি বাহা’ই সমাজে অর্ন্তভূক্ত হন।এরফলে মিথ্যা রটনাকারীদের থেকে গ্রামবাসী মুখ ফিরিয়ে নেয়।
ভানপুর গ্রামে অমায়িক, বন্ধুভাবাপন্ন পরপোকারী ব্যক্তি হিসেবে ‘নানা (আশরাফুল বিশ্বাস)র সুখ্রাতি ছিল।একের পর এক মিথ্যা অভিযোগ দিয়েও নানা-র বাহাই ধর্মীয় কর্মকান্ড বন্ধ না করতে না পেরে কুচক্রী মহল ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে। নানার সমস্ত আবাদী জমির ফসল তারা নষ্ট করে দেয়। জমিতে কৃষিশ্রমিকদের কাজ করতে বাধা দান করে। দির্ঘদিন এই অত্যাচার নির্যাতন অব্যাহত থাকে। কিন্তু তাতেও বাহাই ধর্মের প্রতি নানার অটল বিশ্বাসে ফাটল ধরাতে না পেরে ভারপুরসহ পাশ্ববর্তী ১০ গ্রামের সমন্বয়ে পঞ্চায়েত ডেকে নানা-র তার বিরুদ্ধে ধর্ম বিরোধী আখ্যা দিয়ে শালিশ ডাকা হয়। শালিশে ধর্ম বিষয়ে ‘নানা’-র অগাধ জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য দেখে কথিত আলেমরা হতবাক হয়ে যায়, নানার বিরুদ্ধে ধর্মবিরোধী কোন অভিযোগ প্রমানে ব্যর্থ হয় আলেমরা। বাহাই বিশ্বাসকে ভুল প্রমানে ব্যর্থ হয়ে কুচক্রীমহল উপস্তিত শালীসি নেতাদের সামনেই নানার উপর হামলা করে, প্রচন্ডভাবে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। তার মাথা ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে। তার বসতবাড়ি ভেঙ্গে দেওয়া হয়। অবশেষে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় তাকে গ্রাম থেকে বিতাড়িত করা হয়। একজন হাইস্কুলের শিক্ষক নিয়ে এমন ঘটনা বিশেষ করে বাংলাদেশের গ্রাম অঞ্চলে আজকের দিনেও তা অকল্পনীয়। পরবর্তীতে স্থানীয় সরকারী কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে তিনি বাড়িতে ফিরতে সক্ষম হন।
আশরাফুল বিশ্বাস নানা নিয়মিত বাহা’ই ধর্ম প্রচার কাজে অংশ নেন। ভানপুরে যে সকল পিতা-মাতা বাহা’ই হয়েছিলেন. তাদের সন্তানদের নিয়ে তিন বাহা’ই শিশু ক্লাসের পরিচালনা করতেন। সেই শিশু ক্লাসের ছেলে-মেয়েরা, আজ অনেকেই পিতা-মাতা। তারা শ্রদ্ধা ভালোবাসার সাথে স্মরণ করেন যে, তারা প্রথম বাহা’ই প্রার্থনা এবং গান নানার কাছেই শিখেছিলেন। সেদিনের ছোট ছোট বাহাই শিশুরা আজকে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এবং বাহা’ই সমাজেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। আশরাফুল বিশ্বাস তাদের জীবনে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তারা তা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে।
আশরাফুল বিশ্বাস প্রথম থেকেই খুবই ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন।1974 সাল থেকে 2006 সাল পর্যন্ত
শিক্ষক হিসেবে চাকুরি করেন।বাহাই হিসেবে ঘোষণা দিবার পূর্বে তিনি ইসলাম ধর্মের সকল নিয়ম এবং আচার অনুষ্ঠান নিষ্ঠার সাথে পালন করতেন। একজন শিক্ষিত, স্বচ্ছল এবং সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গ্রামে পরিচিত ছিলেন। একদিকে যেমন তিনি ধর্মের বাহ্যিক রীতি-নীতি পালন করতেন, অপরদিকে তিনি ধর্মের সামাজিক এবং মানবিক দিক সম্পর্কেও অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। গ্রামের অন্যান্য ব্যক্তি কৃষিশ্রমিকদের যে অর্থ দিতো, তিনি তার জমিতে কাজ করা দিনমজুরদের অনেক বেশী পারিশ্রমিক দিতেন। গ্রামের অভাবী মানুষদেরকে উদারভাবে সহায়তা করতেন। গ্রামের মানুষ ঠিকই জানতো যে কোন অভাব অনটনে নানার কাছ থেকে কেউ খালি হাতে ফিরতো না।।
২৯ মে ২০২০-এ নানার শেষ কৃত্যের সময় পুনরায় গ্রামের অন্ধকুসংস্কারাচ্ছন্ন কুচক্রীমহল নানাভাবে বাধা প্রদান করে। গ্রামের কবর খননকারীদেরকে কবর খুড়তে বাধা প্রদান করে, এমনকি কাফনের কাপড় কিনতে গেলে নানার সন্তানের নিকট কাফনের কাপড় বিক্রয়ে অসম্মতি জানায়। দুরবর্তী গ্রাম থেকে কাফনের কাপড় ক্রয় করা হয় । কিন্তু এই সকল বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও আশরাফুল বিশ্বাস নানাকে যথাযথ সম্মানের সাথে সম্পূর্ণ বাহা’ই নিয়ম অনুসারে তার পারিবারিক গোরস্থানে সমাহিত করা হয়। সমাধিস্থ করার প্রকৃয়াটিও নাটকীয়তাপূর্ণ ছিলো, যখন বাহা’ই অনুসারীরা নিজেরাই কবর খোড়া শুরু করে তখন কিছু গ্রামবাসী এসে আপত্তি জানাল যে, গ্রামের মুসলিম কবরস্থানের পাশে বাহাই কবর হতে দিবে না, কারণ তাতে মৃতব্যক্তিদের প্রার্থনার জন্য আগত মুসলিম গ্রামবাসী বিব্রত বোধ করবে। তখন আশরাফুল বিশ্বাসের ছেলে রবি বিম্বাস দৃঢ়ভাবে এ কথার প্রতিবাদ করে, রবি বলে- ‘এই জায়গা আমার বাবার এবং তিনিই সেখানকার সবচেয়ে ভালো জায়গা পাবেন।’ অবশেষে নানা বাধা বিপত্তি পেরিয়ে মহাদেশীয় উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য ড. জব্বার ঈদেলখানীর উপস্থিতিতে বিশেষ প্রার্থনা পাঠের মাধ্যমে আশরাফুল বিশ্বাস নানার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
জাতীয় আধ্যাত্মিক পরিষদ এবং বাহাই বিশ্বের সর্বোচ্চ পরিচালনা পরিষদ ‘সার্বজনীন বিচারালয়’ তার মৃত্যুতে ভালোবাসাপূর্ণ বার্তা প্রেরণ করেন।
আশরাফুল বিশ্বাসের মৃত্যুর সংবাদ জেনে তিনি তিন দশকেরও বেশী সময় পথিকৃত হিসেবে বাংলাদেশে দায়িত্বপালনকারী বাহা’ই বন্ধু সাঈদ হাকিকি- বলেছেন ‘নানা’র বিরুদ্ধে যখন বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার চলছে তখন সাইদ রাজশাহীতে থাকতেন। সাহায্যকারী বোর্ডের সদস্য তাকে এবং আর একজনকে পথিকৃত বেহরুজ নবাভীকে ভানপুর গিয়ে আশরাফুল বিশ্বাসের সাথে দেখা করতে বললেন।’ সাঈদ হাকিকি আরো বলেনন যে- ‘আমরা দুপুরের মধ্যে ভানপুর পৌছালাম। আমরা দেখলাম তার মুখে তখনও আঘাতের চিহৃ ছিল এবং ব্যণ্ডেজ করা ছিল। তিনি আমাদেরকে তার ক্ষতিগ্রস্থ ঘর এবং ধানক্ষেত দেখালেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, যারা এই সকল অন্যায়ের জন্য দায়ী তাদের সাথে দেখা করবো। বিকেল পাঁচটার দিকে তাদের সাথে আমাদের দেখা হল। হামলাকারীদের মধ্যে নেতৃত্বদানকারী আমাদের সাথে ভাল ব্যবহারই করল। নানার বিরূদ্ধে তাদের আক্রোশের মূল কারণও তাদের মুখ থেকে আমরা জানতে পারলাম। তারা বল্লো- আশরাফুল বিশ্বাস খুবই ভাল মানুষ। তিনি আমাদের গ্রামের মসজিদে ইমামতীও করেছেন কিন্তু এখন তিনি কেন ইসলাম ধর্মের বিরোধিতা করেছেন? আপনারা আমাদেরকে বুঝান, আপনারা যদি সন্তোষজনক উত্তর দিতে না পারেন তবে- আপনারা ভানপুর থেকে প্রাণ নিয়ে ফেরত যেতে পারবেন না।’
আমার সঙ্গী বেহরুজ-এর ইসলামের ভবিষ্যতবাণী সম্পর্কে ভাল জানাছিল, সে উপস্থিত সবাইকে জানালো যে, আশরাফুল বিশ্বাস ইসলাম বিরোধী কিছু বলছেন না বরং এই যুগের জন্য কোরান এবং হাদিসে যে সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে, তাই আপনাদেরকে বলেছেন। তারা খুব মনোযোগের সাথে বেহরুজের প্রত্যেকটি কথা শুনছিল এবং আমি মনে মনে আব্দুল বাহা’র সেই কথা স্মরণ করেছিলাম যে, ‘তোমরা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস রেখে মুখ খুলো আমি তোমাদের মাধ্যমে কথা বলবো।’ আমি সেই দিন তার প্রমাণ দেখলাম। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত এই আলোচনা চললো, তারপরে আমরা তাদের বিদায় জানিয়ে শেষ ট্রেন ধরার জন্য পাঁচ কিলেমিটার দুরের টেশনের দিকে পায়ে হেটে রওয়ানা দিলাম। কেউ আমাদেরকে বাধা প্রদান করে নাই। আমরা যখন রাজশাহী পৌছালাম তখন রাত একটা বাজে। আমরা ক্লান্ত কিন্তু আধ্যাত্মিক আনন্দে পরিপূর্ণ ছিলাম।”
একজন কিংবদন্তির প্রস্থান
আশরাফুল বিশায
গ্রামের মেঠো পথ ধরে একদল ছেলে-মেয়ে আনন্দে হৈচৈ করতে করতে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষের পিছনে হাঁটছে, এই দৃশ্যটি হয়তো হ্যামলিনের বংশীবাদকের গল্পের কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। তবে এ গল্পের ব্যক্তি ঐ শিশুদেরকে চিরকালের জন্য কোন অন্ধকার গুহায় বন্দী করার জন্য নিয়ে যান নি। এ গল্প একজন আলোর পথ প্রদর্শক একজন নিবেদিত প্রান শিক্ষকের গল্প। গ্রামের ছেলেমেয়েরা একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের লাভের লক্ষ্যে প্রতিদিন হেঁটে চলতো এই শিক্ষক আশরাফুল বিশ্বাস এর পিছনে। ২৯ মে ২০২০-এ যার মৃত্যু গোটা বাহা’ই সমাজকে শোকাহত করে দেয়।
১৯৮২ সালের দিকের কথা। বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামের মতই আধুনিক সুযোগ সুবিধা, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বঞ্চিত এমনই একটি প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। ভানপুর। রাতের অন্ধকার দুর করতে কেরসিন চালিত কুপি বা হারিকেন ছিল তাদের রাতের আলোর একমাত্র সম্বল। এই গ্রামের সৈয়দপুর শহিদ মঞ্জু উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আশরাফুল বিশ্বাস, যিনি ‘নানা’ নামেই ছোট-বড় সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন। তখনকার দিনে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের এই এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ ছিলো। আর্থিক সামর্থ্য এবং শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া সত্বেও গোদাগাড়ী উপজেলার ভানপুর গ্রামের অনেকেই এই কারণে তাদের সন্তানদেরকে স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী ছিলেন না।
আশরাফুল বিশ্বাস পায়ে হেটে গ্রামে বাড়ি বাড়ি অভিভাবকদের কাছে যেয়ে তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানেরার অনুপ্রেরণা দিতেন। যে সমস্ত অভিভাবকদের স্কুলের বেতন দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না, গোপনে তিনি তাদের স্কুল খরচও বহন করতেন। তার এই অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ভানপুর গ্রাম থেকে ২০ থেকে ২৫ জন সৈয়দপুর হাই স্কুলে ভর্তি হল। শিশুদের প্রতি আশরাফুল বিশ্বাসের সেবা এখানেই থেমে থাকেনি। প্রতিদিন বিকেলে তিনি ঘরে ঘরে গিয়ে স্কুলের ছেলে-মেয়েদের নিজ বাসায় নিয়ে আসতেন। ভাল ফল লাভের লক্ষ্যে ছাত্রদের বিনা টাকায় প্রাইভেট পড়াতেন। তিনি অত্যন্ত যত্ন করে তাদেরকে পড়াতেন এবং তাদের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করতেন। যে সকল ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠ্যপুস্তক কেনার সামর্থ্য থাকতো না, তিনি তাদের বই কেনার ব্যবস্থাও করে দিতেন। এই সবকিছুর বিনিময়ে অভিভাবকদের থেকে কোনদিন তিনি কোন টাকা পয়সা গ্রহণ করেন নাই।
সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার এই সচেতনতা তাকে বামপন্থি রাজনীতির দিকে উদ্বুদ্ধ করে, তিনি নিজেকে সম্পুর্ণরূপে বামরাজনীতির জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। বামরাজনীতির সাথেযুক্ত অন্যন্ত ঘনিষ্ট একজন সহযোগী একদিন নানাকে বলেন- ‘আমরা মানবমুক্তির যে পথ অনুসন্ধান করছি, আমি তা পেয়েছি।’ সে আশরাফুল বিশ্বাসকে বাহা’ই ধর্ম সম্পর্কে জানান। আশরাফুল বিশ্বাস এই নতুন বাণীর সত্যতা সম্পর্কে গভীরভাবে অনুসন্ধান শুরু করেন। বাহাই বিশ্বাস যে মানবমুক্তির প্রকৃত পথ, একথা বুঝতে তার বেশী দিন লাগে নাই। পরিশেষে ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ তিনি নিজেকে একজন বাহা’ই হিসেবে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন।
তিনি বাহা’ই ধর্ম গ্রহণ করার পর অত্যন্ত উৎসাহের সাথে এই ধর্মের মুলবানীসমূহ নিজ গ্রামবাসীদেরকে জানাতে শুরু করলেন। তার এই শিক্ষাদানের মাধ্যমে গ্রামের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি বাহা’ই ধর্ম গ্রহণ করেন। ফলশ্রুতিতে গ্রামে বাহা’ইদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সাধারণগ্রামবাসী ভীত হয়ে পড়ে, গ্রামের ধূর্ত মাতবরদের সাথে গোপন পরামর্শ শেষে কুচক্রী গ্রামবাসী রটনা শুরু করে অর্থের বিরুদ্ধে সকলেই বাহাই ধর্ম গ্রহণ করছে। প্রকৃত সত্যের বানী আলোতে আলোকিত হয়ে দলে দলে গ্রামের সরলপ্রাণ মানুষ বাহাই ধর্মে র পতাকাতলে সমবেত হতে শুরু করে। এই সময় ভানপুর গ্রামের কয়েকজন সম্মানিত, অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল এবং শিক্ষিত ব্যক্তি বাহা’ই সমাজে অর্ন্তভূক্ত হন।এরফলে মিথ্যা রটনাকারীদের থেকে গ্রামবাসী মুখ ফিরিয়ে নেয়।
ভানপুর গ্রামে অমায়িক, বন্ধুভাবাপন্ন পরপোকারী ব্যক্তি হিসেবে ‘নানা (আশরাফুল বিশ্বাস)র সুখ্রাতি ছিল।একের পর এক মিথ্যা অভিযোগ দিয়েও নানা-র বাহাই ধর্মীয় কর্মকান্ড বন্ধ না করতে না পেরে কুচক্রী মহল ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে। নানার সমস্ত আবাদী জমির ফসল তারা নষ্ট করে দেয়। জমিতে কৃষিশ্রমিকদের কাজ করতে বাধা দান করে। দির্ঘদিন এই অত্যাচার নির্যাতন অব্যাহত থাকে। কিন্তু তাতেও বাহাই ধর্মের প্রতি নানার অটল বিশ্বাসে ফাটল ধরাতে না পেরে ভারপুরসহ পাশ্ববর্তী ১০ গ্রামের সমন্বয়ে পঞ্চায়েত ডেকে নানা-র তার বিরুদ্ধে ধর্ম বিরোধী আখ্যা দিয়ে শালিশ ডাকা হয়। শালিশে ধর্ম বিষয়ে ‘নানা’-র অগাধ জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য দেখে কথিত আলেমরা হতবাক হয়ে যায়, নানার বিরুদ্ধে ধর্মবিরোধী কোন অভিযোগ প্রমানে ব্যর্থ হয় আলেমরা। বাহাই বিশ্বাসকে ভুল প্রমানে ব্যর্থ হয়ে কুচক্রীমহল উপস্তিত শালীসি নেতাদের সামনেই নানার উপর হামলা করে, প্রচন্ডভাবে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। তার মাথা ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে। তার বসতবাড়ি ভেঙ্গে দেওয়া হয়। অবশেষে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় তাকে গ্রাম থেকে বিতাড়িত করা হয়। একজন হাইস্কুলের শিক্ষক নিয়ে এমন ঘটনা বিশেষ করে বাংলাদেশের গ্রাম অঞ্চলে আজকের দিনেও তা অকল্পনীয়। পরবর্তীতে স্থানীয় সরকারী কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে তিনি বাড়িতে ফিরতে সক্ষম হন।
আশরাফুল বিশ্বাস নানা নিয়মিত বাহা’ই ধর্ম প্রচার কাজে অংশ নেন। ভানপুরে যে সকল পিতা-মাতা বাহা’ই হয়েছিলেন. তাদের সন্তানদের নিয়ে তিন বাহা’ই শিশু ক্লাসের পরিচালনা করতেন। সেই শিশু ক্লাসের ছেলে-মেয়েরা, আজ অনেকেই পিতা-মাতা। তারা শ্রদ্ধা ভালোবাসার সাথে স্মরণ করেন যে, তারা প্রথম বাহা’ই প্রার্থনা এবং গান নানার কাছেই শিখেছিলেন। সেদিনের ছোট ছোট বাহাই শিশুরা আজকে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এবং বাহা’ই সমাজেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। আশরাফুল বিশ্বাস তাদের জীবনে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তারা তা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে।
আশরাফুল বিশ্বাস প্রথম থেকেই খুবই ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন।1974 সাল থেকে 2006 সাল পর্যন্ত
শিক্ষক হিসেবে চাকুরি করেন।বাহাই হিসেবে ঘোষণা দিবার পূর্বে তিনি ইসলাম ধর্মের সকল নিয়ম এবং আচার অনুষ্ঠান নিষ্ঠার সাথে পালন করতেন। একজন শিক্ষিত, স্বচ্ছল এবং সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গ্রামে পরিচিত ছিলেন। একদিকে যেমন তিনি ধর্মের বাহ্যিক রীতি-নীতি পালন করতেন, অপরদিকে তিনি ধর্মের সামাজিক এবং মানবিক দিক সম্পর্কেও অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। গ্রামের অন্যান্য ব্যক্তি কৃষিশ্রমিকদের যে অর্থ দিতো, তিনি তার জমিতে কাজ করা দিনমজুরদের অনেক বেশী পারিশ্রমিক দিতেন। গ্রামের অভাবী মানুষদেরকে উদারভাবে সহায়তা করতেন। গ্রামের মানুষ ঠিকই জানতো যে কোন অভাব অনটনে নানার কাছ থেকে কেউ খালি হাতে ফিরতো না।।
২৯ মে ২০২০-এ নানার শেষ কৃত্যের সময় পুনরায় গ্রামের অন্ধকুসংস্কারাচ্ছন্ন কুচক্রীমহল নানাভাবে বাধা প্রদান করে। গ্রামের কবর খননকারীদেরকে কবর খুড়তে বাধা প্রদান করে, এমনকি কাফনের কাপড় কিনতে গেলে নানার সন্তানের নিকট কাফনের কাপড় বিক্রয়ে অসম্মতি জানায়। দুরবর্তী গ্রাম থেকে কাফনের কাপড় ক্রয় করা হয় । কিন্তু এই সকল বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও আশরাফুল বিশ্বাস নানাকে যথাযথ সম্মানের সাথে সম্পূর্ণ বাহা’ই নিয়ম অনুসারে তার পারিবারিক গোরস্থানে সমাহিত করা হয়। সমাধিস্থ করার প্রকৃয়াটিও নাটকীয়তাপূর্ণ ছিলো, যখন বাহা’ই অনুসারীরা নিজেরাই কবর খোড়া শুরু করে তখন কিছু গ্রামবাসী এসে আপত্তি জানাল যে, গ্রামের মুসলিম কবরস্থানের পাশে বাহাই কবর হতে দিবে না, কারণ তাতে মৃতব্যক্তিদের প্রার্থনার জন্য আগত মুসলিম গ্রামবাসী বিব্রত বোধ করবে। তখন আশরাফুল বিশ্বাসের ছেলে রবি বিম্বাস দৃঢ়ভাবে এ কথার প্রতিবাদ করে, রবি বলে- ‘এই জায়গা আমার বাবার এবং তিনিই সেখানকার সবচেয়ে ভালো জায়গা পাবেন।’ অবশেষে নানা বাধা বিপত্তি পেরিয়ে মহাদেশীয় উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য ড. জব্বার ঈদেলখানীর উপস্থিতিতে বিশেষ প্রার্থনা পাঠের মাধ্যমে আশরাফুল বিশ্বাস নানার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
জাতীয় আধ্যাত্মিক পরিষদ এবং বাহাই বিশ্বের সর্বোচ্চ পরিচালনা পরিষদ ‘সার্বজনীন বিচারালয়’ তার মৃত্যুতে ভালোবাসাপূর্ণ বার্তা প্রেরণ করেন।
আশরাফুল বিশ্বাসের মৃত্যুর সংবাদ জেনে তিনি তিন দশকেরও বেশী সময় পথিকৃত হিসেবে বাংলাদেশে দায়িত্বপালনকারী বাহা’ই বন্ধু সাঈদ হাকিকি- বলেছেন ‘নানা’র বিরুদ্ধে যখন বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার চলছে তখন সাইদ রাজশাহীতে থাকতেন। সাহায্যকারী বোর্ডের সদস্য তাকে এবং আর একজনকে পথিকৃত বেহরুজ নবাভীকে ভানপুর গিয়ে আশরাফুল বিশ্বাসের সাথে দেখা করতে বললেন।’ সাঈদ হাকিকি আরো বলেনন যে- ‘আমরা দুপুরের মধ্যে ভানপুর পৌছালাম। আমরা দেখলাম তার মুখে তখনও আঘাতের চিহৃ ছিল এবং ব্যণ্ডেজ করা ছিল। তিনি আমাদেরকে তার ক্ষতিগ্রস্থ ঘর এবং ধানক্ষেত দেখালেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, যারা এই সকল অন্যায়ের জন্য দায়ী তাদের সাথে দেখা করবো। বিকেল পাঁচটার দিকে তাদের সাথে আমাদের দেখা হল। হামলাকারীদের মধ্যে নেতৃত্বদানকারী আমাদের সাথে ভাল ব্যবহারই করল। নানার বিরূদ্ধে তাদের আক্রোশের মূল কারণও তাদের মুখ থেকে আমরা জানতে পারলাম। তারা বল্লো- আশরাফুল বিশ্বাস খুবই ভাল মানুষ। তিনি আমাদের গ্রামের মসজিদে ইমামতীও করেছেন কিন্তু এখন তিনি কেন ইসলাম ধর্মের বিরোধিতা করেছেন? আপনারা আমাদেরকে বুঝান, আপনারা যদি সন্তোষজনক উত্তর দিতে না পারেন তবে- আপনারা ভানপুর থেকে প্রাণ নিয়ে ফেরত যেতে পারবেন না।’
আমার সঙ্গী বেহরুজ-এর ইসলামের ভবিষ্যতবাণী সম্পর্কে ভাল জানাছিল, সে উপস্থিত সবাইকে জানালো যে, আশরাফুল বিশ্বাস ইসলাম বিরোধী কিছু বলছেন না বরং এই যুগের জন্য কোরান এবং হাদিসে যে সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে, তাই আপনাদেরকে বলেছেন। তারা খুব মনোযোগের সাথে বেহরুজের প্রত্যেকটি কথা শুনছিল এবং আমি মনে মনে আব্দুল বাহা’র সেই কথা স্মরণ করেছিলাম যে, ‘তোমরা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস রেখে মুখ খুলো আমি তোমাদের মাধ্যমে কথা বলবো।’ আমি সেই দিন তার প্রমাণ দেখলাম। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত এই আলোচনা চললো, তারপরে আমরা তাদের বিদায় জানিয়ে শেষ ট্রেন ধরার জন্য পাঁচ কিলেমিটার দুরের টেশনের দিকে পায়ে হেটে রওয়ানা দিলাম। কেউ আমাদেরকে বাধা প্রদান করে নাই। আমরা যখন রাজশাহী পৌছালাম তখন রাত একটা বাজে। আমরা ক্লান্ত কিন্তু আধ্যাত্মিক আনন্দে পরিপূর্ণ ছিলাম।”
———লেখক
মাহমুদুল হক